• ফুটবল

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...

পোস্টটি ৩২৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচ্চিতিনিকে টিভি পর্দাতে কল্পমানব লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর্জেন্টাইন ঐ খর্বকায় লোকটা যেভাবে "লোয়ার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি" নিয়ে মাঠজুড়ে ভেসে বেড়ান - অদৃশ্য কোনো আঠা দিয়ে যেন পায়ের সাথে বল জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর। ঘটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই কোনদিকে যাবেন, সাঁই করে ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন আচমকাই। বাধা তো আসবেই - কেউ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে চাইবে, থামিয়ে যেতে চাইবে জার্সি ধরে টানাটানি করে। কিন্তু নিরাসক্তের মতো গোত্তা খেয়ে এগিয়ে যাবেন ফুটবল যাদুকর, পড়ে যেতে যেতেই সামলে নেবেন, চোখের নিমেষে বল জড়িয়ে দেবেন জালে। অতীতে আন্তোনি গওদি কিংবা হোয়ান মিরোরা কাগজ-ক্যানভাসে শিল্প ফুটিয়ে তুলেছেন, বর্তমানে বল পায়ে ছুটে চলা অদম্য মেসি কাতালানদের সবচেয়ে বড় শিল্পী।

 

লিওনেল মেসি ফুটবলীয় ভাষায় যেটাকে বলে "ট্রিকারি" - সেটার ধার ধারেন না। খুব সাধারণ কাজগুলোই এতোটা দক্ষতার সাথে করেন যে দেখে মনে হয় ফুটবল খেলাটা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজগুলোর একটা। এক টার্নেই তিনদিক দিয়ে ঘিরে ধরা ডিফেন্ডারদেরকে ছিটকে ফেলতে পারেন, বক্সের আশপাশের যে কোন জায়গা থেকে গোলকিপারদেরকে বোকা বানাতে পারেন। আগুয়ান গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বড্ড "চিপ" বানিয়ে ফেলা চিপশটগুলো আমাদের হতবাক করে দেয়, শামীম চৌধুরী ফুটবলের ধারভাষ্য দিলে হয়তো বলবেন এগুলো মেসির "ডাল-ভাত" শট। ফ্রি-কিকে আস্তে আস্তে সেরাদের একজন হয়ে উঠেছেন, বক্সের ধারেকাছে রেফারি ফাউলের বাঁশি বাজালেই প্রতিপক্ষ গোলপ্রহরীর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় নিশ্চয়ই। ছোট কিংবা লম্বা পাসে যেমন সতীর্থদের খুঁজে নিতে যেমন ভুল হয় না, তেমনি বক্সে ঢুকে ঠিকঠাক জায়গা বের করতেও দুইবার ভাবতে হয় না। লিওনেল মেসি যেন মানববেশী এক নিখুঁত রোবট যার একমাত্র কাজ স্পেনসহ বাকি ইউরোপের দলগুলোকে ধ্বংস করে চলা।

lionel-messi-5k-2018-1i

লিওনেল মেসির গল্পের শুরুটা যেন হলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্য মেনেই শুনেই শুরু হয়েছে। বার্সেলোনা থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মাইল দূরের আর্জেন্টাইন শহর রোজারিওতে জন্ম নেওয়ায়। শরীরে গ্রোথ হরমোনের অভাব ফুটবল ক্যারিয়ার তো দূরে থাক সুস্থভাবে জীবন-যাপন করার ক্ষমতাকেই কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। কিন্তু মেসির স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে মেলবন্ধন হয়ে এলো ফুটবল। ফুটবল মাঠে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে চিকিৎসার পুরো খরচ তুলে নিলো বার্সেলোনা। নিজে জাতে আর্জেন্টাইন হলেও মেসির পূর্বপুরুষদের বেশিরভাগই ছিলেন ইতালির অধিবাসী, কিছুটা কাতালান রক্তও বইছে তাঁর ধমনীতে। সেই রক্তের অলৌকিক টানেই হয়তো লিও মেসির নতুন ঠিকানা হলো স্পেনের "ক্রীড়াশহর" বার্সেলোনায়। ক্লাবের একাডেমি "লা মাসিয়া" থেকে বিশ্বের সেরা হয়ে ওঠা - পথটা দীর্ঘ হলেও একবারের জন্যও মনে হয়নি মেসি ব্যর্থ হবেন। ফুটবল বিধাতা যাকে একেবারে নিজ হাতে গড়েছেন, তাঁর কি দমে যাওয়া সাজে। ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা আর কঠোর পরিশ্রম - দুইয়ে মিলেই আজকের মেসি। যেই ক্লাব তাঁকে দূরদেশ থেকে তুলে এনে ফুটবল সিংহাসনে বসিয়েছে তাঁদের প্রতি মেসির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ঠিক, ক্যারিয়ারটাও হয়তো শেষ করবেন ওখানেই। ততদিন পর্যন্ত ফুটবলের রেকর্ডের ভাংগা-গড়ার খেলায় মগ্ন মেসির কীর্তি দেখতে বোধহয় ন্যু কাম্পের দর্শকদের এতটুকুও ক্লান্তি বোধ হবে না।

wp2961952

গোল না হলে ফুটবল খেলা জমে না - এ কথা নিশ্চয়ই ঘোরতর ফুটবলবিরোধীরাও মানবেন। এক বেরসিক গোলি বাদে বাকি ১০ জনের মনের আনাচে-কানাচেতেই গোলের চিন্তা উঁকি মারে। লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে গোল উদযাপন করেছেন সাতশ এর বেশি, প্রতিটার কথা বলতে গেলে হয়তো আর দিনদশেক লাগতে পারে। কিন্তু এতশত গোলের মাঝেও কয়েকটি মহাকালের চিরবহমানতার মাঝেও নিজেদের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। গেতাফের বিপক্ষে সেই গোলের কথা মনে আছে? ১৯ বছর বয়সী মেসির যেভাবে মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে ছয়জনকে পরাস্ত করে জাল খুঁজে নিলেন সেটা দেখে ফুটবল বিশ্ব তাঁর দেশেরই আরেকজন বাঁ-পেয়ের কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল। সারাগোসার বিপক্ষে হ্যাট্ট্রিকের দ্বিতীয় গোলটাই বা ভুলে যাবেন কিভাবে? রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনাল দ্বিতীয় লেগে আঁকাবাঁকা দৌড়ে পাঁচজন মাদ্রিদ খেলোয়াড়কে পরাস্ত করে ইকার ক্যাসিয়াসকে পরাস্ত করা কিংবা পরের বছরেই স্প্যানিশ সুপার কাপে তিরিশ গজি ফ্রি-কিক। জেরোম বোয়াটেংকে ঘোল খাইয়ে বায়ার্নের বিপক্ষে সেই অবিশ্বাস্য চিপটা তো ইন্টারনেট সংস্কৃতির অংশই হয়ে গেছে। ১৩-১৪ মৌসুমে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য বাঁক খাওয়ানো শটে গোল করেছিলেন মেসি, থিবো কর্তোয়া হয়তো প্রাণপণ চাইলেও মন থেকে সেই ভয়াল সুন্দরের দৃশ্য মুছে ফেলতে পারবেন না। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ০৯-১০ মৌসুমের হ্যাট্ট্রিকের প্রথম গোলটা "টিপিকাল মেসি", অন্য অনেকেই হয়তো পড়ে পড়ে গিয়ে পেনাল্টি আদায়ের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতেন, কিন্তু তিনি যে মেসি! তাই দাঁতে দাঁত চেপে বল জালে জড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ ছিল তাঁর। ১২০ গজের মঞ্চে একরকম কতশত বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন, দিচ্ছেন, দেবেন। গেলো মৌসুমেও লিগে মোট ৪৬ গোলে সরাসরি অবদান আছে তাঁর, তবুও একটু কি বুড়িয়ে যাচ্ছেন? জাতীয় দলের হয়েও ৭০ বার গোল করেছেন, কিন্তু থাক সে কথা। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ফুটবল জাতির একটির প্রতিনিধিত্ব করলেও ভাগ্যের ফেরে এখন পর্যন্ত শিরোপার মুখদর্শন করা হয়নি। বিশ্বকাপের ফাইনালে হাতছোঁয়া দূরত্বেই ছিলেন, কিন্তু "জার্মান মেশিন"- এর যাঁতাকলে পিষ্ট সে স্বপ্ন। পেনাল্টি শ্যুটআউট কোপা আমেরিকা থেকে শুন্য হাতে ফিরিয়েছে। আন্তজার্তিক অংগণে আদৌ ট্রফি পাবেন কিনা তাঁর উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু ভাগ্যদেবীর অনুগ্রহ খুব শিগগিরি পেতে হবে, সময় যে ফুরিয়ে আসছে।

1879542-39587840-1600-900

আরেকটি বছর পেরিয়ে যাওয়া মানে অনিবার্য পরিণতির দিকে আরেকটু এগিয়ে যাওয়া। মেসিও কোনো একদিন মাঠে থাকবেন না, থাকার সুযোগ কিংবা ক্ষমতাই থাকবে না। তোরে দেল রেলোতগে টাওয়ারের ঘড়িটা ঠিকঠাক সময় বলে যাবে আগের মতই, লা সেগ্রাদা ফ্যামিলিয়া সূর্যের আলোতে ঝলমল করবে, পার্ক গুয়েলের ভিড় একটুও পাতলা হবে না। কিন্তু সেদিন ন্যু ক্যাম্পের গ্যালারিতে "মেসি, মেসি" রব উঠবে না, মাঠে নামা ২২ জনের মধ্যে মেসিকে চাইলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই মেসির ফুটবল সুধা আকণ্ঠ পান করুন, আর খুব বেশিদিন এই সুযোগ পাবেন না। তবুও যতদিন ফুটবল থাকবে, বার্সেলোনা থাকবে - ততদিন লিও মেসির নামটাও উচ্চারিত হয়ে যাবে। আর আপাতত থামার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছেন না প্রতিপক্ষের জন্য এই মূর্তিমান আতঙ্ক। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাকে এখনো অনেক কিছু দেওয়ার বাকি আছে লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচ্চিতিনির। ডিফেন্ডার-গোলিদের বোকা বানিয়ে বলটাকে আরো অনেকবার জালে পাঠাতে হবে যে! কিন্তু বিদায় তো নিতে হবে একদিন, তারপর? বল পায়ে আঁকাবাঁকা দৌড়ে ডিফেন্ডারদেরকে পর্যুদস্ত করতে দেখা যাবে না তাঁকে। বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে জাল আর কাঁপবে না সেদিন। মেসির নামের বদলে ভক্তদের কণ্ঠে অন্য কারো নাম উচ্চারিত হবে হয়তো। কিন্তু অনেকের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস আসবে, আসতে বাধ্য। হারানো ভালোবাসাকে কি আর ভোলা যায়? লিও মেসি যে একজনই!